আবার সকলে তাকিয়ে নবান্নের দিকে! এ খেলা চলবে নিরন্তর …
দীপঙ্কর গুহ:
আদালতের রায় অনেক সময় আগের কোনও কেসের রায় ধরে বিচারের রাস্তা খুঁজে দেয়। আজ সেই পুরনো নমুনা কি সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের হাতিয়ার হতে পারে? – এইটুকু পড়ে মোটেই ভাববেন না , বিসিসিআই কিংবা আইসিসি নিয়ে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় অন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন। বোর্ডের দরজা মুখের উপর বন্ধ হয়ে যাওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কি সৌরভ শেষ দেখে নেওয়ার লড়াইয়ে নামবেন? আবার গিয়ে বসবেন সি এ বি ক্লাব হাউসের প্রেসিডেন্টের ঘরে?
সেই নমুনাটা হাতড়ে দেখতে পারেন মহারাজ। তাঁর গডফাদার জগমোহন ডালমিয়ার কেস স্টাডি এমনটা ভাবার সুযোগ দিতে পারে। আইসিসি চেয়ারম্যান পদের দায়িত্ব শেষ করে ডালমিয়া আবার সি এ বি সি সভাপতি হয়েছিলেন। পরে আবারও বিসিসিআই সভাপতিও হয়েছিলেন। মৃত্যুর সময়ও তিনি সি এ বি-র সভাপতিই ছিলেন। তাহলে সৌরভ কেন নন?
লোধা কমিটির আগের নিয়ম হলে হয়তো এসব ভাবা যেত না। এখন মহামান্য শীর্ষ আদালত যে নুতন রায় দিয়েছেন – তাই হাতিয়ার করে জয় শাহ তো আবারও বোর্ডের সচিব হয়ে বসে পড়ছেন। তাহলে সৌরভ নন কেন?
বহু ক্রিকেটপ্রেমী কিংবা কট্টর দাদাপ্রেমীরা কাল থেকে এখনও পর্যন্ত সব জেনে – শুনেও বুঝতে চাইছেন , সবটা কি রাজনীতির খেলা? নানান প্রশ্নের জানা উত্তরগুলো দিয়েছি। কিন্তু যে প্রশ্ন গুলোর উত্তর মেলাতে নিজেই পারছি না — সেগুলো আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করি।
১. সৌরভ কি জানতেন না, তাঁকে দ্বিতীয়বার আর সভাপতি করা হবে না ?
২. উত্তর যদি হয় ” জানতেন” , তাহলে প্রশ্ন: কেন তিনি নিজের নাম সি এ বি থেকে বিসিসিআইতে পাঠালেন ? ( নিজে তো পাঠাননি, ক্ষমতাবলে সেটাই করিয়ে ছিলেন)
৩. বোর্ডে চাপ সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন? নাকি নির্বাচনে লড়ে যেতে চেয়েছিলেন?
৪. আগের প্রশ্নের পরের অংশের উত্তরটা নিশ্চিতভাবে জানি – সেটা নয়। অর্থাৎ নির্বাচনে লড়ে যেতে চাইতেন না। তাহলে প্রথম পর্বেরটাই ঠিক ধরি। প্রশ্ন সেখানেই, বোর্ড রাজনীতিতে তিনি ডাঁহা ফেল – এটা বুঝেও কেন এমন “আমাকে দ্যাখো – আমাকে দ্যাখো” আবেদন নিয়ে দরবার করলেন?
৫. তাহলে তো এখন মনে হচ্ছে প্রথমবার ব্রিজেশ প্যাটেলকে সরিয়ে শেষ রাতে বাজি জিতে ছিলেন – ক্রিকেটীয় পন্থার বাইরে কিছু করে। তাহলে সেই পন্থাটা কেন এবার কাজে লাগলো না?
৬. সোমবার মুম্বই গিয়েছিলেন সৌরভ। কেন? সেদিন রজার বিনি মনোনয়ন জমা দিচ্ছিলেন। সূত্র বলছে, সৌরভ শেষ চেষ্টা চালিয়ে ছিলেন। কিন্তু প্রাক্তন বোর্ড সভাপতি এন শ্রীনিবাসন সামান্য সময়ের জন্য মুম্বই ছুঁয়ে চলে যান চেন্নাই। সেদিনও তিনি বোর্ড সভাপতি হয়ে সৌরভ ব্যর্থ – এটা বোর্ড সদস্যদের সামনে বলে যান। সৌরভের হয়ে কোনও কর্তা কেন মুখ খোলেননি?
৭. সৌরভ – ক্রিকেটার আর অধিনায়ক যতটা জনপ্রিয়, ততটাই অপ্রিয় ক্রিকেট প্রশাসক হয়ে? মাঠের দক্ষ নেতা, মাঠের বাইরে এসব সামলাতে পারলেন না কেন?
৮. মোটামুটি সকলে জানেন, এখন দেশের এইসব সংস্থা কেন্দ্রের শাসক গোষ্ঠীর ( পড়ুন বি জে পি) আঙ্গুলি হেলনে চলে। তাহলে, সেই আঙ্গুল কেন ধরতে পারলেন না? হাত ধরা না হয় পরের কথা। কি এমন শর্ত ছিল,যা সৌরভ সামলাতে ব্যর্থ?
এবার রটনা নিয়ে প্রশ্ন আছে।
বাংলার প্রচার মাধ্যমে হৈ চৈ তুঙ্গে – বিজেপিতে সৌরভ যোগ না দেওয়ায় এই হাল হল। এটাকে সত্যি বলে যদি মানি, তাহলে প্রশ্ন হল: সৌরভ সভাপতি হওয়ার সময় কি এই শর্ত নিয়ে চেয়ারে বসেছিলেন?
সৌরভ ঘনিষ্ঠরা বার বার দাবি করেছেন – মহারাজ রাজনীতিতে আসবে না। তাই যদি হবে – তাহলে নিজের দিকে হওয়া টানতে রাজনৈতিক মঞ্চকে কেন কাজে লাগিয়ে গিয়েছেন বারবার? কেন নবান্নে গিয়ে সিএবি – সভাপতি হয়েছিলেন? রাজ্য ক্রিকেট সংস্থার যুগ্ম সচিব তো তাঁকে তখনকার সিএবি সভাপতি জগমোহন ডালমিয়াই করেছিলেন। তখন তো ডালমিয়া রাজনীতির কুশীলবদের নির্দেশে চলতেন না। সৌরভ সেদিনও সি এ বি- তে নির্বাচন জিতে প্রশাসক হননি। পরে একই খেলায় বোর্ড সভাপতি হয়েছিলেন। এখন সেই লবিকে আর আয়ত্ত্বে রাখতে পারলেন না!
সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় কেন স্পষ্ট করে কেন বলছেন না, ” আমি মাঠ ভালবাসি। মাঠেই থাকতে চাই। প্রশাসনিক পদে আর নেই।” জানি ক্ষমতার শীর্ষে ঘোরাফেরা করা চরিত্ররা এটা পারেন না। অনেক কিছু চারধারে ততদিনে ভীড় করে ফেলে। সারা দেশে বিভিন্ন মহলে কথা বলে বুঝেছি, বোর্ডের এই খেলায় সৌরভের পাশে দাঁড়িয়ে সহানুভূতি পর্যন্ত নেই। যা কিছু আছে : এই বাংলায়। বাঙালি মহলে।
এক প্রাক্তন জাতীয় ক্রিকেটার নাম প্রকাশ করা যাবে না এই শর্তে যা যা বললেন, তা হল : ” সৌরভ যে ভাবে সভাপতি হয়েছিল, সেটা ওর ইমেজের সঙ্গে মানানসই ছিল না। বিসিসিআই সভাপতি বা সচিব হতে কেন কপিলদেব বা গাভাসস্কর হওয়ার চেষ্টা করেননি? ওরা চাইলেই পারতো। সানি তো বোর্ডের বিপদে কোচ বা সভাপতি হয়ে সামান্য দিনের জন্য কাজ করেছিলেন। কপিল কোচ হয়েছিলেন। পতৌদি সভাপতি হয়ে কয়েকমাসের স্টপ গ্যাপে সার্ভিস দিয়েছিলেন। কই সচিন – দ্রাবিড় – কুম্বলে – সেওয়াগ – লক্ষণরা তো এমন কিছু হওয়ার রাস্তায় হাটে নি। কুম্বলে – শ্রীনাথ – দ্রাবিড় তো কর্ণাটক রাজ্য সংস্থার সচিব – সভাপতিও হয়েছেন। বোর্ডের রাজনীতিতে জড়াতে চাননি। সৌরভ যাও বা গেলেন, প্রথম ক্রিকেটার – সভাপতি হয়ে অনেক বেশি ক্লিন ইমেজ নিয়ে কাজ করা উচিত ছিল। কেন বোর্ডের কর্তারা আজ বলার সুযোগ পাচ্ছে – সৌরভ এই দায়িত্ব সামলাতে ব্যর্থ!”’
সৌরভ যদি এই দ্বিতীয় বারের জন্য সভাপতি বা আইসিসি চেয়ারম্যান হওয়ার জন্য বিসিসিআই তে দরবার না করতেন – তিনি মাথা উঁচু করেই থাকতেন। ” আমার মাঠই , আমার জায়গা” – এটা বলে হয়তো তিনি টিভিতে ক্রিকেট এক্সপার্ট হয়ে বসতে পারতেন। আইপিএলে মেন্টর হয়েছেন, এবারও হতে পারবেন। দিল্লি – লখনউ তো তাঁকে চায়। এরপর ছিল: জাতীয় দলের মেন্টর হয়ে বসা। আসলে তিনি সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় — তাঁর সবকিছু অন্য রকম হবে। এই মানসিকতা তাঁকে অনেকবার কোণঠাসা করেছে। আবার তিনি প্রবলভাবে ফিরে এসেছেন।
এখন তাহলে?
কিছু পরিস্থিতি সাজানো যাক।
এক : আবার সি এ বি সভাপতি পদে বসা। ২২ অক্টোবর এবার সংস্থার সব পদের জন্য মনোনয়ন পত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন। এবারও সেই নবান্নে যাবে এই ইস্যু। অর্থাৎ আবার সেই রাজনীতির কুশীলবদের হস্তক্ষেপ। সৌরভকে সেই রাজনীতির অলিন্দে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। সেটা হলে তাঁর দাদা স্নেহাশিসকে থেকে যেতে হবে সচিব পদে।
দুই : ঋদ্ধিমান সাহাকে বাংলা ছাড়তে হওয়ায় , রাজ্যে ক্রীড়াপ্রেমী মুখ্যমন্ত্রী ক্ষুব্ধ ছিলেন। সৌরভ সেই সময় অনেক পরে বিশেষ কয়েকজনকে কাজে লাগিয়ে ( নিজে কনফারেন্স কলের এক প্রান্তে নীরব থেকে) কিছুই করতে পারেননি। যে সি এ বি কর্তার জন্য এই ঘটনা ঘটে তাঁকে কিছু না বলে, উপহার স্বরূপ সিনিয়র জাতীয় দলের ম্যানেজার করে পাঠানো – কোনও মহল ভালো চোখে নেয়নি। এমনকি এবার সিএবি-র সভাপতি দৌড়ে থাকা সৌরভের দাদা স্নেহাশিসের ( সচিব পদে থেকে) ঋদ্ধিমানের বিরুদ্ধে মন্তব্য করা – কেউ ভোলেননি। তাই ‘বোর্ড কুর্শি কিসসা ‘ ঘটে যাওয়ার আগে : নবান্নও অন্য কিছু ভেবে রেখেছিল। সেই ভাবনাকে ধাক্কা দেওয়ার চ্যালেঞ্জ এখন আর নেবেন বলে মনে হয়না।
তিন: সৌরভ নিজের তিন বছরের বাকি মেয়াদ বাঁচিয়ে দাদাভাইকে ( স্নেহাশিসকে) সভাপতি করতে পারেন। সচিব পদে তাহলে মেনে নিতে হবে, নবান্নের পছন্দের প্রার্থী এক মূখ্যমন্ত্রীর অতি প্রিয় সাংবাদিককে। যিনি গত দুটি বছর থেকে ইস্ট বেঙ্গল ক্লাবের প্রতিনিধি হয়ে সি এ বি তে যাচ্ছেন। কিন্তু যুগ্ম সচিব পদে থাকা সেই বিতর্কিত কর্তা টিকে নিয়ে সৌরভ কী করেন – তাই কোটি টাকার প্রশ্ন।
চার: আইনি জটিলতা। সৌরভ ৫ বছর ৪ মাস সি এ বি তে কাটিয়ে বোর্ডে গিয়েছিলেন। তাহলে তাঁর সি এ বি তে আরও ৮ মাস থাকার পর তিন বছরের কুলিং অফে যাওয়ার কথা। কিন্তু নয়া নির্দেশে বোর্ড সভাপতি বা বোর্ডের কর্তারা টানা ছটি বছর কাজ করে যেতে পারবেন। সৌরভের কী ভাবনা – এটা দেখার। প্রচুর ব্র্যান্ড এনডোর্সমেন্ট করেন এখন। কোনও পদে না থাকলে এই তিন বছরে তার এই বাজার কোথায় যাবে? দেশের মাটিতে ২০২৩ সালে বিশ্বকাপ আছে। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় শুধু কি প্রাক্তন জাতীয় ক্রিকেটার হয়ে সেই সময় কাটাতে চাইবেন? নাকি কোনও একটি রাজ্য সংস্থার শীর্ষে বসে বোর্ডের উপর চাপ রেখে যাবেন।
এইসব উত্তর মিলতে , আর ৪৮ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে। এটাও কিন্তু রাজনৈতিক সিধ্যান্ত হতে চলেছে। সৌরভ তো বটেই, গোটা বাংলা ক্রিকেট মহল তাকিয়ে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মাননীয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশের দিকে তাকিয়ে।
সত্যি , এই সিএবি – তে আজ সেই রাজ নেই! একমত হয়ে ক্লাব প্রতিনিধিরা কোনও যে সিদ্ধান্ত নিয়ে বুঝিয়ে দেবেন – রাজনীতি দূর হটো, সেটা হওয়ার নয়। কারণ সকলে জানেন। সৌরভ ইস্যু এখন রাজনীতির ব্যবসায়ীদের দখলে!! সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় কি সেই সুযোগটা করে দিয়েছেন? উত্তর আপনারা পছন্দ মতন বসিয়ে নিন।