হিমালয়ের কোল আলো করে এক ফুটফুটে আদুরে সদ্যজাত
কলমে: দিব্যদ্যুতি বিশ্বাস
ভূগোল বই এর পাতায় ভূ-প্রকৃতি, পাহাড়-পর্বত, ঝর্না, নদনদী, অরণ্য, জীব বৈচিত্র্য পড়তে পড়তেই কল্পনার ক্যানভাসে নিজের মত করে এঁকে নেওয়া আর তারপরে কল্পনার সাথে বাস্তবের কতটা মিল টা চাক্ষুষ করার ইচ্ছা নিয়ে ছুটে যাওয়া, এমন ইচ্ছা কার না হয় বলুন? তবে এই জায়গা টির উল্লেখ সেভাবে কোথায় বই এর পাতায় নেই, তাই এই জায়গা টির আশেপাশে ঘুরে বিভিন্ন তথ্য অনুসন্ধান করতে করতে আপনি নিজেই হয়তো আবিষ্কার করে ফেলতে পারেন নতুন কিছু আর কলম্বাস কিংবা ভাস্কো দা গামা-র মত খুলে দিতে পারেন নতুন এক অজানা দিগন্ত।
নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে গাড়ি তে মাত্র ঘন্টা ছয়েকের দূরত্বে পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং জেলায় রয়েছে নৈসর্গিক আভায় ভরপুর ছোট্ট এই পাহাড়ী গ্রাম “শ্রীখোলা”। প্রকৃতি প্রেমী ভ্রমণ পিপাসু দের কাছে জায়গাটি এক আকর্ষণীয় নতুন উইক এন্ড ডেস্টিনেশন হয়ে উঠতে চলেছে অদূর ভবিষ্যতে।
শহুরে দূষণ, যানজট, কংক্রিটের জঞ্জাল থেকে অনেক অনেক দূরে ঘন জঙ্গলে ঘেরা পাহাড়ী পথ নদী উপত্যকা গিরিখাত শীতলতার ও নির্জনতার মাঝে মানসিক শান্তি খুঁজে মন কে রিফ্রেশ করে নিতে চাইলে একবার টি আসতেই হবে এখানে। গিরিরাজ হিমালয়ের কোল আলো করে থাকা ছোট্ট এই গ্রামের সৌন্দর্য্য কে যেন পরম স্নেহে আদরে যত্নে ঢেলে সাজিয়েছে পরমা প্রকৃতি।এমন শান্ত উন্মুক্ত প্রাকৃতিক পরিবেশ স্বস্তির নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্যে যেন সত্যিই আদর্শ ঠিকানা। সিঙ্গলীলা শৈলশিরায় অবস্থিত
ছোট্ট এই গ্রামের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে হিমালয়ের ঝর্নার জলে পুষ্ট খরস্রোতা এক নদীর শান্ত জলধারা আর এই নদীর নামেই ট্যুরিস্ট স্পটের নাম “শ্রীখোলা”।
কিভাবে আসবেন:
হাওড়া কিংবা শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে নিউ জলপাইগুড়ি সেখান থেকে ট্রেকার বা অটো করে আসতে হবে তেনজিং-নোর্গে বাস স্ট্যান্ড। ওখান থেকে প্রতিদিন সকাল 11-টায় জন প্রতি 700/- টাকায় শেয়ারিং এ মিলবে শ্রীখোলা যাওয়ার গাড়ি। আপনি চাইলে রিজার্ভেও যেতে পারেন সেক্ষেত্রে ভাড়া বেশি পড়বে। আবার কেউ চাইলে কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি গামী বাসে অথবা বিমানে বাগডোগরা হয়েও আসতে পারেন।
পথে যেতে যেতে কি কি দেখবেন:
শ্রীখোলার উদ্দেশ্যে যেতে যেতে পথের দুপাশে দেখতে পাবেন সবুজে ঘেরা চায়ের বাগিচা, পথেই দেখতে পাবেন বালাসন নদী, গিরিখাত আর সেইসাথে জঙ্গলের রাস্তার মধ্যে দিয়ে চলতে চলতে সেলফি তোলার জন্যে আদর্শ বেশ কিছু ভিউ পয়েন্ট পাবেন। মিরিকের কাছাকাছি পৌঁছে পথে যেতে যেতে স্লিপিং বুদ্ধ কাঞ্চনজঙ্ঘার নৈসর্গিক দৃশ্য দেখতে অবশ্যই ভুলবেন না! মিরিকের আশেপাশে দোকান থেকে সংগ্রহ করে পারেন ইয়াক (চমরি গাই) এর দুধের স্বর দিয়ে তৈরি সুস্বাদু ছুপরি। শ্রীখোলা পৌঁছাতে পৌঁছতে সূর্যি মামা অস্ত যাবে ফলে ওই দিন শ্রীখোলা পৌঁছাতে পৌঁছাতে গোধূলির আঁধার নেমে আসবে।
রাতে কোথায় থাকবেন:
শ্রীখোলা পৌঁছেই রয়েছে বেশ কিছু হোমস্টে। যার মধ্যে অন্যতম, বিখ্যাত এবং সবচেয়ে ঐতিহ্যপূর্ণ GTA এর গভর্নমেন্ট একোমডেশান Srikhola Treker’s Hut।
হালকা বৃষ্টিস্নাত হাড় হিম শীতল আবহাওয়ার মাঝে কাঠে আগুন ধরিয়ে, ক্যাম্প-ফায়ার করে, মিউজিক বাজিয়ে নাচ গান, বন-ফায়ার করে আগুন পোহানো, চিকেন পুড়িয়ে খাওয়া আর সাথে সোমরসের গ্লাসে চুমুক – এরকম এক অভূতপূর্ব ফিলিং নিতে চাইলে “শ্রীখোলা ট্রেকারস হাট” রাত কাটানোর আদর্শ ঠিকানা।
কি কি ঘুরে দেখবেন ওখানে:
পরদিন সকালে শান্ত শ্রীখোলা নদীর পাড়ে বা নদীর মাঝে থাকা ছোট ছোট টিলায় বসে দার্জিলিং চায়ের স্বাদ নেওয়ার সুন্দর অনুভূতি জাস্ট ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না । শ্রীখোলা ব্রিজের উপরে দাঁড়িয়ে ফোটশুট করার সময় নিজেকে বরফি ফিল্মের রণবীর কাপুর কিমবা প্রিয়াঙ্কা চোপড়া মনে হতেই পারে। ওখান থেকে স্থানীয় গাড়ি তে চেপে সাইড সিনে যেতে হবে।রয়েছে ব্ল্যাক ফরেস্ট যেখানে দিনের বেলাও ঘুটঘুটে অন্ধকার, হিংস্র জীবজন্তু যেমন ভল্লুক আর চিতা বাঘের মুক্তাঞ্চল হওয়ায় একটু সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। তাই হাইকিং করতে চাইলে বা ব্ল্যাকফরেস্টে গেলে, সাথে একজন গাইড নিয়ে নেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শ্রীখোলা ট্রেকার্স হাট থেকেই চাইলে গাইড এর ব্যাবস্থা হয়ে যাবে। তবে নিজেরাও আশেপাশের এলাকা ঘুরে দেখতেই পারেন। রক ক্লাইম্বিং বা হাইকিং করে পাহাড়ে উঠে হিমালয়ের নৈসর্গিক দৃশ্য দেখতে চাইলে যেতে হবে “জরায় পোখরি”, যাকে অনেকেই দার্জিলিং এর ” জোর পোখরি”র সাথে গুলিয়ে ফেলেন। যাইহোক, “জরায় পোখরি” পৌছে দেখবেন, পাহাড়ের চূড়ায় রয়েছে একটি সুন্দর লুকোনো জলাশয়(হিডেন লেক) ও একটা জাগ্রত শিবলিঙ্গ। কথিত আছে বহু প্রাচীন এই শিবলিঙ্গ ও জলাশয়ে মানসিক করলে মনস্কামনা পূর্ণ হয়।
এছাড়াও রিম্বিকের দুর্গম আঁকাবাঁকা পথে ওখানকার ট্যুরিস্ট গাড়িতে করে মানেদারা এলাকায় দেখতে যেতে পারেন প্রায় দেড় শত বছর পুরোনো সুসজ্জিত এক বৌদ্ধ মনেস্ট্রি – “সামটেন গুম্বা”। অনেক ইতিহাসের সাক্ষী এই প্রাচীন মনেষ্ট্রি। রিম্বিকেই আছে একটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, আর নিত্য প্রয়োজনীয় ও স্থানীয় পোশাক আসাক ও মনোহারী জিনিসপত্র কেনাকাটার চাইলে ঘুরে দেখতে পারেন রিম্বিক বাজার। শ্রীখোলা ট্রেকার্স হাট থেকে কয়েকশ ফুট উঁচু রাস্তায় পায়ে হেঁটে স্থানীয় দের সহযোগিতায় বলে চিনে নিতে পারেন রাস্তার দুপাশে পাহাড়ের গায়ে থাকা হিমালয়ের দুষ্প্রাপ্য হার্বাল প্ল্যান্ট গুলি। রয়েছে প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরী বিভিন্ন ভিটামিন এর গাছ মাউথ ওয়াশ কিমবা স্যানিটাইজার ট্রি। দেখে মনে হতেই পারে রাস্তার পাশে জংলী গাছ; তবে এগুলি ঠিক কোন কোন রোগের মহৌষধী তা জানলে আপনার চোখ কপালে উঠতে বাধ্য! এছাড়াও নানান পাহাড়ী ফুলের সৌন্দর্য্য তো আছেই।যারা পোষ্য প্রেমী তারা চাইলে সঙ্গে করে নিজেদের পোষ্য সারমেয় টিকেও সঙ্গে আনতেই পারেন, ওখানে রয়েছে ওর অনেক বন্ধু সারমেয় যারা ক্ষনিকের মধ্যেই বন্ধু হয়ে উঠতে পারে ওর, আপনার, সবার।
এ তো গেল যারা পাহাড়ী গ্রাম শ্রীখোলা তে ভ্রমণ করতে চান তাদের জন্য প্রয়োজনীয় কিছু তথ্য। তবে যারা পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ সান্দাকফু থেকে ট্রেকিং করে ফিরছেন তাদের জন্যেও আদর্শ বেস ক্যাম্প অবশ্যই শ্রীখোলা ট্রেকর্স হাট।GTA এর নিয়ন্ত্রণাধীন এই ট্রেকার্স হাট টি তে থাকার জন্য আছে সিঙ্গেল বেডের রুম,ঘরের কাঁচের জানলা দিয়ে রিভার মাউন্টেন ভিউ, কিছু কিছু ঘরে অনেকগুলি সিঙ্গেল বেড আছে যেখানে একাধিক ট্রেকার রুম শেয়ার করে থাকতে পারবেন।তবে ফ্যামিলি নিয়ে চাইলে আলাদা ঘরে থাকতেই পারেন তবে সেক্ষেত্রে ঘর একটা হলেও বেড আলাদা আলাদাই হবে। তবে অবশ্যই হলফ করে বলা যায় ট্রেকর্স হাটের দায়িত্বে থাকা কেয়ারটেকার দের ব্যবহার বন্ধু সুলভ আচরণ ও আতিথেয়তা আপ্যায়ন আপনাদের মুগ্ধ করবে। ক্ষণিক সময়ের মধ্যেই ওরা হয়ে উঠবে আপনাদের কাছের বন্ধু। ওখানে মাথাপিছু প্রতিদিন থাকা খাওয়ার খরচ ও খুবই সামান্য। এছাড়া রয়েছে যাতায়াত ও সাইট-সিইং ঘুরে দেখার জন্যে আলাদা গাড়ির খরচ। তবে অবশ্যই মধ্যবিত্ত ভ্রমণ পিপাসদের সাধ্যের মধ্যেই। অনেকেই পরিচিত জায়গায় গিয়ে ক্লান্ত হয়ে উঠেছেন; জায়গা গুলি হয়ে উঠেছে হাতের তালুর মত চেনা একঘেঁয়ে তাদের জন্যে তো বটেই সেই সাথে কলেজে এডুকেশনাল ট্যুর (এক্সকার্শন) বা অফ বিট ট্রাভেলার্স কিংবা পাহাড়-প্রকৃতি প্রেমী দের জন্যেও নিরিবিলি একান্তে নির্জন প্রকৃতির মাঝে সময় কাটানোর ক্ষেত্রে এই লোকেশন টি আদর্শ। এখানে আসলে এখানকার মনোরম পরিবেশ যে আপনাকে মুগ্ধ করবে তা বলাই বাহুল্য। থাকার জন্যে ট্রেকার্স হাট ছাড়াও ওখানে আরও বেশ কিছু হোম স্টে রয়েছে।
তাহলে আর চিন্তা কি চটপট অনলাইন বুকিং সেরে ফেলুন কিংবা এসেও বুক করতে পারেন আর ঘুরে দেখুন শ্রীখোলার নৈসর্গিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য।