একজন শিল্পীর মৃত্যু

SATYAM NEWS

কলমে – সুমন ভট্টাচার্য :- এক সরলরেখায় দাঁড়িয়ে,অর্থাৎ ১৮০ ডিগ্রি থেকে যে তিন কাঠিতে বল রাখা যায়, গোল করা যায় সেটা সুরজিত সেনগুপ্ত প্রথম আমাদের জানিয়েছিলেন| গত শতকের ৭ এর দশকে শিল্ড সেমিফাইনালে দক্ষিণ কোরিয়ার দলের বিরুদ্ধে লাল হলুদ জার্সি গায়ে সুরজিত সেনগুপ্তের ওই গোলটা আজও আমার চোখে লেগে আছে| জেনে গিয়েছিলাম কোনও শিল্পী ফুটবলার হলে বল পায়ে ওইরকম সোয়ার্ভ করাতে পারেন| গোলকিপার এবং স্ট্রাইকার একই সরলরেখার উপর দাঁড়িয়ে, এই অবস্থায় বল গোলকিপারকে টপকে জালে জড়িয়ে দিতে গেলে পায়ে যে সোয়ার্ভ করানোর দক্ষতা থাকতে হয়, যে অসম্ভব ক্ষমতা, সুরজিত সেনগুপ্তের সেটা ছিল|

মনে রাখবেন কলকাতা ময়দানে, শিল্ড সেমিফাইনালে একটি বিদেশি দলের বিরুদ্ধে সুরজিত সেনগুপ্তের করা ওই অসাধারণ গোলের অনেক দিন পরে ইউরোপীয় কাপে ডাচ তারকা মার্কো ভন বাস্তেন প্রায় কাছাকাছি ধরনের একটি গোল করে গিয়েছিলেন যা আজও আন্তর্জাতিক ফুটবলে সর্বকালের সেরা গোলের তালিকায় ঢুকে আছে| আমরা আজও ইউটিউবে বা ভিডিওতে বাস্তেনের ওই গোলটি দেখি| কিন্তু সুরজিত সেনগুপ্তের ওই গোলটির কোনও ভিডিও অনেক খুঁজেও পাওয়া যায় না| পেলে হয়তো বাঙালির মনে থাকত, আজকের প্রজন্ম জানতো সুরজিত সেনগুপ্ত আসলে কতটা শিল্পী ফুটবলার ছিলেন| শিল্পী ফুটবলার| এই শব্দবন্ধটাই বোধহয় আজকে প্রয়াত ফুটবলার সম্পর্কে যথার্থ বিশেষণ| গত শতকের সেই ৭ কিংবা ৮ এর দশকে যখন আমরা ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ চিনি না, কেবল টিভির দৌলতে গোটা দুনিয়ার ফুটবল একেবারে আমাদের রান্নাঘরে মা কাকিমাদের কাছে পর্যন্ত পৌছে যায়নি,তখন বাংলায় ছাপা কিছু খেলার পত্রিকাই আমাদের কাছে ফেসবুকে পরমা সুন্দরীর ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এর মতো ছিল|

আজ যেমন অন্যের টাইমলাইনে গিয়ে ছবি দেখতে অনেকে বুঁদ থাকেন, গত শতকের ওই দশকগুলোতে আমার মতো অনেক কিশোরই খেলার পত্রিকার ছবিতে মগ্ন থাকত| সেই ফেলে আসা সময়ের দুই অবিস্মরণীয় তারকা সুরজিত সেনগুপ্ত আর মজিদ বাসকর| একটি খেলার পত্রিকায় একজন খ্যাতকীর্তি ক্রীড়া সাংবাদিক লিখেওছিলেন, আসলে গোটা মাঠটা ছিল সুরজিতের কাছে ক্যানভাস|

নিজের অসামান্য ড্রিবলের দক্ষতা দিয়ে, বিপক্ষের ডিফেন্স চেরা থ্রু দিয়ে সুরজিত সেনগুপ্ত সেই মাঠে, সেই ক্যানভাসে ছবি আঁকতেন| অনেক পরে যখন নেহরু কাপ, দূরদর্শনে বিশ্বকাপের সম্প্রচার কিংবা মাঝে মধ্যে লাইটহাউস বা নিউ এম্পায়ারে জায়ান্টস অফ ব্রাজিল দেখে যখন আন্তর্জাতিক ফুটবলের সঙ্গে আমাদের পরিচয় হচ্ছে, যখন জর্জ বেস্ট এর সেই অবিস্মরণীয় ড্রিবল বা লাতিন আমেরিকার ফ্রান্সিসকোলিকে দেখছি, বিশ্ব ফুটবলের শিল্পসুষমাকে চিনছি, তখন চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হতো, আমাদেরও একজন সুরজিত সেনগুপ্ত ছিল| মনে রাখবেন সুরজিত সেনগুপ্ত সেই বিরল বাঙালি হিন্দু ফুটবলার, যিনি মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গলের মতো মহমেডানেও চুটিয়ে খেলেছেন| সেই জন্যই সুরজিত সেনগুপ্ত বাঙালি আইকন| এমন আইকন যিনি কোনও সংবাদপত্রগোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠ হতে পারেন, কোনও পত্রিকাগোষ্ঠীর ক্রীড়া পত্রিকার সম্পাদকও হতে পারেন, কিন্তু এই সবকিছুকে ছাড়িয়ে বাঙালির অহঙ্কার| আজ আসলে সুরজিত সেনগুপ্ত মারা গেলেন না, পুড়ে ছাই হয়ে যাবে বাঙালিয়ানার সেই অহঙ্কার|

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *