বিরাট কোহলি: কুছ তো লোগ কেহেঙ্গে, লোগো কা..
দীপঙ্কর গুহ: পিতৃকালীন ছুটি নিয়েছিলেন। অস্ট্রেলিয়া সফরের মাঝপথে, দেশে ফিরেছেন। ভারতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক হয়ে, গত বছর এমন ঘটনা প্রথম বার সকলে দেখেছিলেন। নেতা বিরাট কোহলি গতবছরের এমনই এক সময় দেশে ফিরে এসেছিলেন। আবার এবার সেই সময় চলবে, বিদেশের মাটিতে দক্ষিণ আফ্রিকা সফর। ছোট্ট মেয়ের এক বছর বয়স হবে। প্রচার মাধ্যমের একটি অংশ এখনই গল্পের গরু গাছে তুলে দিয়েছে। চোট পাওয়ায় রোহিত শর্মা টেস্ট সিরিজে খেলতে যাচ্ছেন না। কিন্তু একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচের সিরিজে নেতৃত্ব দিতে ( এই প্রথমবার) ভিনদেশের মাটিতে দল নিয়ে নামবেন। গপ্পো ছড়াতে শুরু করেছে। চোট নিয়ে রোহিত দেশের হয়ে টেস্ট দলের সঙ্গে থাকছেন না। অর্থাৎ বিরাটের নেতৃত্বে খেলতে নামছেন না। বিরাট কোহলি নাকি রোহিত দলের দায়িত্ব নিলেই, দেশে ফিরে আসবেন! তাঁর বিশ্রাম চাই। ভিকে নাকি একদিনের আন্তর্জাতিক সিরিজটিতে খেলবেন না!
কে রটিয়ে দিল , জানা নেই। বিসিসিআই সচিব জয় শাহ এমন কিছু এখনও , কোহলির থেকে শোনেননি। বোর্ড সভাপতি সৌরভও জানেন না। কোষাধক্ষ্য অরুণ ধুমাল আবার সর্বভারতীয় এক চ্যানেলে বলে বসেছেন, তিনি এমন কিছু শুনেছেন! এইকথা প্রচার মাধ্যমের একাংশ জানে! সকলে কি বিজ্ঞ! ভাবাই যায় না!
কোহলি মুম্বইয়ে দলের সঙ্গে সামান্য কয়েকদিনের প্রস্তুতিতে যোগ দেননি। তিনি,রোহিত,রাহানে – তিনজনই বোর্ডের থেকে সবুজ সংকেত নিয়ে হোম কোয়ারিন্টাইনে ছিলেন। রোহিত তার মধ্যেই নেট প্রাক্টিস করেছেন। চোটও পেয়েছেন। রাহানে আবার বিনোদ কাম্বলির কাছে গিয়েছিলেন।
বিরাট নাকি বোর্ডের একাংশের উপর চটেছেন! ( সম্ভব কিনা – সেটা ক’জন জানেন? ) কোহলি বিশ্ব ক্রিকেটের একজন তারকা। বড় ব্রান্ড। আধুনিক ক্রিকেট মানেই, কর্পোরেট কালচার। তা যদি হয়, তা হলে – অসফল নেতাকে কেন ( সীমিত ওভারের ক্রিকেটে) বইবে বোর্ড? কিন্তু সেই নেতা যথেষ্ট বড় ‘ম্যাচ উইনার’। বোর্ড সেই ম্যাচ উইনার কোহলিকে চায়।
তারজন্য কি কি করা যায়? একজন সফল প্রাক্তন অধিনায়ক সব বোঝেন, জানেনও। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় তাই যা যা করা উচিত জাতীয় দলের এক অধিনায়কের সঙ্গে তাই করেছেন, বলেই জানলাম। সীমিত ওভারের আইসিসি টুর্নামেন্টে সাফল্য নেই – কোহলিকে মুখের উপর সেটা বলেননি নিশ্চই। বরঞ্চ বলে থাকবেন হয়তো , কোহলিকে দেশ কোন ভূমিকায় দেখতে চায়।
এভাবে বোর্ড তাঁকে ৫০ ওভারের দলের অধিনায়ক পদ থেকে সরিয়ে দেবে – তা সেই কুড়ি – কুড়ি ম্যাচের নেতৃত্ব ছাড়ার সময় থেকে শোনা যাচ্ছিল। সেটাই হল। কোনও সন্দেহ নেই, তিনি এমনটা চাননি। ৫০ ওভারের একটা আইসিসি টুর্নামেন্টে ট্রফি ছোঁয়ার বাসনা তাঁর ছিল। তা ভারতীয় বোর্ড কর্তারা চাননি ( কেউ কেউ পড়তে পারেন, বোর্ড সভাপতি চাননি)। আর অপেক্ষা করতেই চাননি।
কোহলি কথা:
কিন্তু গুরুত্ত্বপূর্ণ দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে যাওয়ার আগে কোহলি এ কী ভার্চুয়্যাল প্রেস কনফারেন্স করে গেলেন! কি কি বলে গেছেন?
* আমি টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে ওই ফরম্যাটে আর দলকে নেতৃত্ব দেবো না বলে দিয়েছিলাম। আমাকে কেউ ( ইঙ্গিত ছিল, বোর্ড সভাপতি ) এই দায়িত্ব না ছাড়ার কথা বলেনি। বরঞ্চ সঠিক সিধ্যান্ত , সময়োপযোগী বলেই প্রতিক্রিয়া পেয়েছি।
* আমি কখনও কাউকে আগে থেকে জানাইনি, দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে ওয়ান ডে সিরিজে খেলবো না। বিশ্রাম নেবো। আমি দেশের হয়ে খেলার সুযোগ পেয়েছি। সেটাই আমার কাছে অগ্রাধিকার পায়।
* ফেলে আসা প্রায় আড়াই বছর ধরে কতবার বলেছি, রোহিত আর আমার মধ্যে কোনও বিভেদ নেই। এটা বলে বলে আমি ক্লান্ত।
সৌরভ বচন:
সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, বোর্ড প্রেসিডেন্ট কোহলিকে সীমিত ওভারের ক্রিকেট নেতা পদ থেকে সরানোর পর বলেছিলেন, তিনি বা বোর্ডের পক্ষ থেকে নাকি এভাবে কোহলিকে টি টোয়েন্টি ক্রিকেট দলের নেতৃত্ব ছাড়তে বারণ করা হয়েছিল।
কিন্তু কোহলি অন্য কথা বলেছেন।
সৌরভ বলেছিলেন : নির্বাচকরা সাদা বলের জন্য দুই অধিনায়ক চাইছে না, ওরা চায় সাদা বলে একজন, লাল বলের অন্যজন। অর্থাৎ ৫০ ওভার আর ২০ ওভারের টুর্নামেন্টের জন্য একজন নেতা। আর টেস্ট ম্যাচের জন্য ভিন্ন নেতা। তাই এবার রোহিত আর বিরাট হলেন।
কোহলির বিস্ফোরক অনলাইন প্রেস কনফারেন্স হওয়ার পর, কলকাতায় স্থানীয় প্রচার মাধ্যমের সামনে সৌরভ বলে দিয়েছেন: আর কোনো প্রেস রিলিজ নয়, কনফারেন্স নয়। যা করার বিসিসিআই করবে।
কি কি করতে পারে বোর্ড?
১. টেস্টে নেতা কোহলির সহকারী দিয়ে দেবে। কে হবে? সেই ক্রিকেটারের নাম যদি রবিচন্দ্রন অশ্বিন হন? তাহলে সৌরভ তত্ত্ব কাজ করলো। ‘যা করার বিসিসিআই করবে’। সকলে জানে দেশের সফলতম স্পিনার অশ্বিনের সঙ্গে এই দলের নেতা কোহলির বনিবনা কম। তাই অশ্বিনকে এই পদে বসিয়ে কোহলিকে বার্তা দেবে বিসিসিআই ( বা পড়ে নিন বোর্ড সভাপতি)। বোর্ড কর্তাদের ‘মিথ্যুক’ সাজিয়ে ফেলেছেন যে বিরাট !
২. অশ্বিন ছাড়া অন্য কেউ, কে এল রাহুল কিংবা ঋষভ পন্থ । সহ অধিনায়ক হবেন। তাতে বোঝা যাবে, বোর্ড আর এখন বিতর্ক চায়না। বরঞ্চ, কোহলিকে রানে ফেরার চাপটা বাড়িতে দিতে চায়।তাই শান্তির পথে হাঁটলো।
প্রশ্ন হল- কোহলি, চাইলেও কেন তাঁকে সরানো হল? মাঠের ব্যর্থতা শুধু নেতা কোহলির তো হতে পারেনা। আসলে মাঠের বাইরের বদলা নেওয়া হল। আর তাতে কোচ রাহুল দ্রাবিড়ের সম্মতি ছিল। কি সেই বদলা? সৌরভ – রাহুলের অতি প্রিয় বন্ধু অনিল কুম্বলের অপমানের বদলা। সৌরভ দ্বিতীয়বার চান নি শাস্ত্রী কোচ হন, কিন্তু দক্ষিণ লবির এক প্রাক্তন শক্তিশালী বোর্ড কর্তাকে ধরে বিরাট সেদিন কুম্বলেতে আপত্তি জানান। আর শাস্ত্রীকে চান। সেদিন মধ্যস্ততা করতে নেমে ছিলেন সৌরভ। দেখেছিলেন, একরোখা কোহলিকে। সময় তখন কোহলির সঙ্গে ছিল। কুম্বলে আর ফেরেননি। সৌরভ সেদিন এই ব্যাপারটা মানতে পারেননি। তারপর নানান কারণে, কোহলি বিতর্কে জড়িয়েছেন। ভারতীয় ড্রেসিংরুমে অতি প্রিয় পাত্র তিনি আর নন।
সৌরভ তাই নাছোড়বান্দা ছিলেন, এবার শাস্ত্রী – কোহলি জুটি ভাঙতে ( অবশ্যই আইসিসি টুর্নামেন্টে জিততে)। দ্রাবিড়কে রাজি করিয়ে পরের কাজে হাত দেন। প্রায় দেড় বছর সেঞ্চুরি করেননি কোহলি। তিনি চান , ব্যাটসম্যান কোহলিকে। সাজাতে থাকেন ঘুঁটি। নানান খবর লিক হতে থাকে। বোঝা যায় , কোহলি ঘর সামলাতে পারছেন না। টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপের দলে অশ্বিনকে নেতা – কোচ কেউই চাননি। নির্বাচন কমিটির চেয়ারম্যান চেতন শর্মা বাধ্য করলেন, টিম ম্যানেজমেন্টকে – অশ্বিন নিতে। কিন্তু ম্যাচের পর ম্যাচ অশ্বিন বাইরে। বোঝা যাচ্ছিল, কোনও লড়াই চলছে। আর সেই লড়াইয়ে দলের ক্ষতি হচ্ছে। সেই আইসিসি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনাল ধরেই বলছি। নিজের দক্ষতা প্রমাণ করেও প্রথম একাদশে নিয়মিত জায়গা পাননি অশ্বিন।
আমি কোথাও যেন, সৌরভ – চ্যাপেল পর্বে তখনকার এক জাতীয় নির্বাচক কিরণ মোরের সঙ্গে, এখনকার নির্বাচক কমিটির চেয়ারম্যান চেতন শর্মার বেশ কিছু মিল খুঁজে পাচ্ছি। তখন বোর্ড কর্তাদের একাংশের কথামতন, নেতা সৌরভকে সরানো হয়েছিল। এবার সেই সৌরভের বোর্ডের কোন অলিখিত নির্দেশে আপাতত দুটি ফর্ম্যাট থেকে নেতা কোহলিকে সরানো হল। বলতে দ্বিধা নেই, ব্যাটসম্যান সৌরভের থেকে ব্যাটসম্যান কোহলি অনেক এগিয়ে তা পরিসংখ্যান বলে দিচ্ছে।
চেতন শর্মা একটা সময় বোর্ড কর্তা দের দোরে দোরে ঘুরতেন, ওনার টাকা (পেনশন + বেনিভলেন্ট ফান্ডের টাকা) পেতে। তিনি বোর্ড সভাপতিকে যে কত মেল পাঠিয়েছিলেন, ইয়ত্তা নেই। কিছু মেল আমার অ্যাকাউন্টে আজও পরে আছে। সেই চেতন, বকেয়া সব পেয়ে এখন বোর্ড সভাপতি সৌরভের সময়ই নির্বাচন কমিটির চেয়ারম্যান! বলাই যায়: ‘এ খেলা চলছে নিরন্তর’।
কেন এই লড়াই!
সত্যি অবাক লাগে– এমন ইগো নিয়ে লড়াই কিসের জন্য। শেষ প্রেস কনফারেন্স কোহলি যা যা বলে থাকুন, তিনি বাহবা পেয়েছেন বেশি। কারণ, তিনি গদিতে ( টেস্ট দলের অধিনায়কের দায়িত্বে) বসে বলেছেন, তিনি দেশের হয়ে খেলতে চান। দায়িত্বও নিতে চান। বাকি যে যা বলছে, সব মিথ্যা।
নেতৃত্ব থেকে বাদ গিয়ে সৌরভকে কখনও বিসিসিআইয়ের বিরুদ্ধে কিছু বলতে শুনিনি ( চ্যাপেল জামানায়)। আমি নিজে সৌরভ ঘনিষ্ঠদের কাছে থেকে শুনেছি : তোমার **দা তো ওকে বাদ দিয়েছে। আমি কোন উত্তর ওনাদের দিই নি, সত্যিটা না জেনে। পরে যেটা জেনেছিলাম, কিছু কথা কখনোই জনসমক্ষে বলতে পারব না। বলব না।
কিন্তু এটা বলতে পারি, জিও বিরাট। আসলে বিরাট মনে যা মুখেও তা। মাঠে তাঁর বহিঃপ্রকাশ বার বার তাই বোঝা যায়।
কাজ রাহুলের বেড়ে গেল:
কাকতালীয় ভাবে, এবারও জাতীয় দলের নেতা বদল পর্বে রাহুল দ্রাবিড় জড়িয়ে রইলেন। যেমন , চ্যাপেল পর্বে ছিলেন। এবার তিনি কোচ। কোহলি সব জানেন , বোঝেন। ‘রবি ভাইয়া’ নেই, কিন্তু ফোনে তো আছেন। সুনীল গাভাস্কারের পিএমজি কেমন চলছে তা সকলের জানা। দুবাইয়ে নুতন সংস্থার জন্ম ঘটেছে। নয়া ব্যবসায় মন বসিয়েছেন সানি। সঙ্গে কমেন্ট্রি আছে। সকল মুম্বাইকর সঞ্জয় মঞ্জেরেকরের মতন ভুল করেন না। তাই কোহলি ইস্যুতে কোহলির পাশে দাঁড়াননি লিটল মাস্টার। কায়দা করে সিন্ডিকেট কলমে লিখেছেন, বোর্ড সভাপতি বলুন। কপিলও জানেন বিসিসিআই তে ‘এক শর্মা’ আছেন, তাই দিল্লিবাসী হয়েও দিল্লি পুত্তর কোহলির পক্ষ নেননি। উল্টে পরামর্শ দিয়েছেন, এসবে নিজেকে না জড়িয়ে খেলায় মন দাও।
কপিলজী , ম্যাচ ফিক্সিং পর্বে আপনার নাম আসতেই আপনি একবার প্রেস মিট করেছিলেন। আপনাকে অনেক যন্ত্রণা নিয়ে কাঁদতে দেখেছিলাম। ভারতীয় ক্রিকেট অধিনায়কের মুকুট প্রচুর কাঁটায় ভরা। খুলে রাখতে গেলেও, হাত ক্ষত – বিক্ষত হয়। এটা তো বুঝুন, কোহলি শেষ হয়ে যান নি। তিনি বিশ্বের প্রথম ১০ জনের মধ্যে থাকা এক ব্যাটসম্যান। আপনাকে ওঁর পাশে দেখা যাবে ভেবেছিলাম। জানি আপনি ব্যস্ত এখন আপনার সেই কীর্তি ‘৮৩ বিশ্বকাপের জয় নিয়ে বানানো সিনেমা ‘ ৮৩’ নিয়ে। থাকুন। কিন্তু একটু কোহলির জায়গায় নিজেকে বসান। আপনিও তো দেশের নেতা ছিলেন। আপনাকেও একটি ইডেন টেস্টে বাদ পড়তে হয়েছিল। তখনও আপনি কিছুই বলেননি। আজকের কোহলি সেই সাহসটাতো দেখাতে পেরেছে।
বদলা চাই বিরাট :
মুখে নয় , ব্যাট হাতে বদলা চাই বিরাট। দক্ষিণ আফ্রিকা সফর থেকে তা শুরু হোক। টেস্টে হোক। বেশি করে ওয়ান ডে সিরিজে হোক। অন্যের নেতৃত্বে দেশকে তো অনেক ম্যাচ জিতিয়েছেন। আবার শুরু করুন। আপনার স্ত্রী অনুষ্কা আপনার কোনও অপমান সহ্য করেন না। স্বয়ং সানিজি একবার তীর্যক টুইট করে বসে ছিলেন, অনুষ্কা পাল্টা জবাব দেন। সেই ছায়া সঙ্গিনী এই সেদিন আপনাদের বিবাহবার্ষিকীতে টুইট করেছিলেন, আপনি নাকি তাঁর দেখা সবচেয়ে নিরাপদ পুরুষ। আপনি নাকি সফল নায়িকার অনুপ্রেরণা।
আপনি আগামী প্রজন্মের বিশ্বব্যাপী ক্রিকেটারদের অনুপ্রেরণা। তা সে আপনি যত ধরনের ব্যবসাই করুন না কেন – তাতে কিছু যায় আসে না। মেসি আর রোনাল্ডো খেলে যা পান, তারচেয়ে বেশি রোজগার করেন হোটেল ব্যবসা থেকে। সে কথা ক’ জন জানে। ক’ জন জানেন, আপনার নিজের চাটার্ড বিমানের কথা? আরও কত কি আপনাকে ঘিরে ঘটে চলেছে। দেশ চায় : ম্যাচ উইনার বিরাট কে।
চাই : বিরাট জয়। বাকিরা পাক ভয়।